হযরত বেলাল (রাঃ)’র সুমধুর আযান
হযরত বেলাল (রাঃ)’র সুমধুর আযানের কথা ৷ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)’র জীবদ্দশায়তিনি প্রতিদিন মদীনার মসজিদের মিনার বা ছাদ থেকে আযান দিতেন৷ তাঁর সুরেলা কন্ঠের আযান আল্লাহর রাসূলের (সাঃ) মনে একদিকে যোগাতো হৃদয় জুড়ানো অনাবিল প্রশান্তির কোমলপরশ, অন্যদিকে যোগাতো আধ্যাত্মিক আনন্দের অব্যক্ত ও স্বর্গীয় প্রাণস্পর্শ৷ বিশেষকরে আল্লাহু আকবার বা আল্লাহ সর্বশ্রেষ্ঠ-এ তাকবীর ধবনি যখন আকাশে বাতাসেপ্রতিধবনিত হতো তখন বিশ্বনবীর মনে বেহেশতি আনন্দের এমন এক শিহরণ জেগে উঠতো যা ভাষায়প্রকাশ করা সম্ভব নয়৷ আযান শুনে বিশ্বনবী (সাঃ) মহান আল্লাহর সাথে সাক্ষাতের জন্যেনিজেকে প্রস্তুত করতেন৷ মুসলমানদের নামাজের জামাতে ইমামতি করার মাধ্যমেসর্বশক্তিমান আল্লাহর সাথে প্রেমময় এ সাক্ষাতে মিলিত হবার জন্যে তিনি সব সময়ই অধীরআগ্রহে অপেক্ষার প্রহর গুণতেন৷ নামাজের সময় হলেই বিশ্বনবী (সাঃ) আবিসিনীয় বেলাল(রাঃ)কে বলতেন, আযান দিয়ে আমার হৃদয়কে প্রশান্ত বা পরিতৃপ্ত কর৷ বিশ্বনবী হযরতমুহাম্মাদ (সাঃ) নামাজকে আধ্যাত্মিক মেরাজ বা উধর্বারোহণ বলে মন্তব্য করেছেন৷ তিনিসমস্ত মন প্রাণ সঁপে দিয়ে নামাজ বা আল্লাহর এবাদতে মশগুল হতেন৷ আল্লাহর রাসূল(সাঃ)সময়মতো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায়ের ব্যাপারে খুবই সুশৃঙখল বা নিয়মানুবর্তিছিলেন৷ তিনি নফল নামাজ আদায়ের জন্যে মধ্যরাতে জেগে উঠতেন৷ মহান আল্লাহর সাথে তাঁর এযোগাযোগ ছিল এত নিবিড় ও গভীর যে তিনি মাঝেমধ্যে পুরো রাতই দোয়া ও এবাদতে কাটিয়েদিতেন৷ বিশ্বনবীর পবিত্র বংশধারায় জন্ম-নেয়া ইমাম হযরত জা’ফর সাদিক (আঃ) তাঁরমাতামহ তথা মানবজাতির জন্যে সর্বোত্তম আদর্শ বিশ্বনবী (সাঃ)’র এবাদতের অভ্যাসসম্পর্কে বলেছেন, আল্লাহর রাসূল মধ্যরাতে জেগে উঠতেন৷ এ সময় তিনি আকাশের দিকেতাকাতেন এবং সূরা আলে ইমরানের সেই আয়াতগুলো পড়তেন যাতে মহান আল্লাহ বিশ্বের সৃষ্টিনিয়ে চিন্তা করতে মানব জাতির প্রতি আহবান জানিয়েছেন৷ এরপর তিনি তাঁর দাঁতমোবারকমাজতেন, ওজু করতেন এবং নামাজের স্থানে গিয়ে তাহাজ্জদ নামাজ আদায় করতেন৷ নামাজ আদায়েমহান আল্লাহর রাসূল (সাঃ) কতোটা আনন্দিত হন তা তাঁর একান্ত অনুগত সাহাবী হযরত আবুযার (রাঃ)’র কাছে বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলেন, হে আবু যার! সর্বশক্তিমান আল্লাহনামাজের মধ্যে আমার আনন্দের ব্যবস্থা করেছেন এবং নামাজকে আমার জন্যে চিত্তাকর্ষককরে দিয়েছেন, যেমনটি তিনি ক্ষুধার্ত এবং তৃষ্ণার্তদের জন্যে খাদ্য ও পানিকেচিত্তাকর্ষক করেছেন; তবে পার্থক্য হলো খাদ্য গ্রহণের পর ক্ষুধার্ত ব্যক্তি পরিতৃপ্তহয় এবং পানি পানের পর তৃষ্ণার্ত ব্যক্তির তৃষ্ণা মিটে যায়, কিন্তু নামাজ পড়ার পরকখনও নামাজের প্রতি আমার আকর্ষণ কমে না৷ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) আরো বলেছেন, আল্লাহর নবীগণ যখনই কোনো ব্যাপারে উদ্বিগড়ব ) হতেন তখনই তাঁরা নামাজে মশগুল হতেন৷মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষের জীবন সুখ বা প্রাচুর্যের পাশাপাশি দ্বন্দ্ব,সংঘাত, ঝঞ্ঝা ও দূর্যোগের উত্তাল তরঙ্গমালায় ভরপুর৷ তাই সব সময়ই নিরাপদ আশ্রয় তার জন্যেজরুরী৷ এবাদত তথা নামাজ এবং দোয়ার মাধ্যমে মানুষ এই নিরাপদ আশ্রয়ই খুঁজে পায়৷ কারণ, দোয়া ও নামাজ মানুষের ক্লান্ত হৃদয়ে প্রশান্তি যোগায় এবং তা মানুষকে সজীব ও সতেজকরে৷ সবচেয়ে বড় কথা দোয়া ও নামাজসব প্রাণের স্রষ্টা সর্বশক্তিমান আল্লাহর সাথেমানুষের যোগাযোগের মাধ্যম৷ নামাজেরসবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব হলো আত্মিকপ্রশান্তি৷ মহান আল্লাহর প্রতি পুরোপুরি মনোযোগ রেখে নামাজ আদায় করা হলে সৃষ্টিররহস্যগুলো স্পষ্ট ও বোধগম্য হবে৷ বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) এ প্রসঙ্গে বলেছেন, যে ব্যক্তি আল্লাহর প্রতি পুরোপুরি মন সঁপে দিয়ে নামাজ আদায় করবে, নামাজ শেষ হবারপর সে ব্যক্তি নতুন জন্ম নেয়া মানুষের মতো নিষপাপ ব্যক্তিতে পরিণত হবে ৷ অর্থাৎতাঁর সমস্ত গোনাহ ও ভুলগুলো মার্জনা করা হবে৷ বিশ্বনবী (সাঃ) ১৪০০ বছর আগে যাশিখিয়ে গেছেন আজকের যুগের মনোবিজ্ঞানীরা তা সত্য বলে স্বীকার করছেন৷ নামাজ ও দোয়ারমাধ্যমে মহান আল্লাহর সাথে সৃষ্ট দৃঢ় বা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক মানুষের মন থেকে উদ্বেগ ওউৎকন্ঠা দূর করে৷ এটা এখন আধুনিক যুগের মনোবিজ্ঞানীরাও উপলব্ধি করছেন৷ প্রকৃত নামাজমানুষের জীবনের সর্বক্ষেত্রে এক অতলান্ত প্রভাব বা ছাপ সৃষ্টি করে৷ নামাজ ও দোয়ারমাধ্যমে মনের সমস্ত কদর্যতা, অহংকার ও গর্ব দূরীভূত হয়ে যায়৷ নামাজ মানুষের মধ্যেসৎ গুণাবলী সৃষ্টি করে এবং সৎকাজের প্রেরণায় মন ভরে দেয়৷ এবাদত বা প্রার্থণারগুরুত্ব প্রসঙ্গে পাশ্চাত্যের চিন্তাবিদ ডক্টর অ্যালেক্সিস কার্ল বলেছেন, কেউ যদিআন্তরিকতা নিয়ে স্রষ্টার এবাদত করে, তাহলে তিনি তাঁর জীবনে বাস্তব পরিবর্তন দেখতেপাবেন৷ প্রার্থণা মানুষকে বিভিন্ন প্রলোভন বা কুমন্ত্রণা প্রতিরোধের শক্তি যোগায়৷বিশ্বনবী (সাঃ) সব সময় জামায়াতে নামাজ আদায় করার ওপর গুরুত্ব আরোপ করতেন৷ তিনিবলতেন,একদল মানুষ যখন সমবেত হয়ে আল্লাহকে স্মরণ করেন মহান আল্লাহর ফেরেশতারাতাদেরকে পরিবেষ্টিত করে রাখে এবং তাঁদের ওপর প্রশান্তি ও আল্লাহর অনুগ্রহ বর্ষিতহতে থাকে৷ যে আল্লাহকে স্মরণ করে, আল্লাহও তাঁকে স্মরণ করে৷ কতো তাৎপর্যপূর্ণবিশ্বনবী(সাঃ)’র এই বাণী! নামাজ আদায়ের জন্যে, বিশেষ করে সামষ্টিক এবাদত বন্দেগীরজন্যে মসজিদইসর্বোত্তম স্থান! আর এ জন্যেই মসজিদে যেতে বা মসজিদে নামাজ আদায়ের ওপরএতো গুরুত্ব দেয়া হয়েছে৷ বিশ্বনবী (সাঃ) বলেছেন, মহান আল্লাহ মসজিদকে পৃথিবীর বুকেতাঁর প্রতিকী বাড়ী বা ঘর বলে বলে অভিহিত করেছেন৷ পৃথিবীর অধিবাসীদের চোখে তারকাযেরকম উজ্জ্বল, বেহেশতের অধিবাসী বা আকাশের অধিবাসীদের কাছেও মসজিদ সেরকম উজ্জ্বল ওপ্রবর্ধমান দীপ্তির উৎস৷ বিশ্বনবী (সাঃ) বলেছেন, যাঁরা মসজিদে প্রবেশ করে, তাঁদেরপ্রতিটি পদক্ষেপের জন্যে দশটি করে সওয়াব লেখা হয় এবং দশটি করে গোনাহ মাফ করা হয়৷বিশ্বনবী (সাঃ) তাঁর ঘনিষ্ঠ সাহাবী হযরত আবু যার (রাঃ)কে বলেছেন, হে আবু যার! যখনতুমি নামাজে দাঁড়াবে, মনে করবে তুমি এক অসীম দয়ালু সত্ত্বার দরজায় করাঘাত করছো৷যাঁরাই অসীম দয়ালু সত্ত্বা বা পরম করুণাময় আল্লাহর দরজায় করাঘাত করে তারা সেদরজাটিকে তাঁর জন্যে খোলা দেখতে পাবে৷ হে আবু যার! এমন কোনো মুমিন বা বিশ্বাসী নেইযে নামাজে দাঁড়িয়ে (আল্লাহর পক্ষ থেকে) বিপুল কল্যাণ ও অনুগ্রহের অধিকারী হয় না৷কারণ, আল্লাহর একজন ফেরেশতা এ ঘোষণা দিয়ে যাচেছন যে,” হে আদম সন্তান! যদি তোমরাজানতে তোমরা নামাজের মাধ্যমে কি অর্জন করছো, কার সাথে কথা বলছো ও কার কাছে দোয়াকরছো তাহলে তোমরা কখনও ক্লান্ত হতে না এবং অন্য কোনো কিছুর প্রতিই মনোযোগী হতে না৷